সমরেশ বসুর ব্যক্তিত্ববোধ ও সংগ্রামী জীবন এখনও প্রাসঙ্গিক

 


বাঙালি এবং বাংলা সাহিত্যের পরিধি ব্যাপক। সুবিস্তৃত এই সাহিত্য সম্ভারে অসংখ্য লেখক কিংবা কবি সাহিত্যিকদের অবদানও অপরিসীম। তবে এদের মাঝেই একজন রয়েছেন যার কেবল সাহিত্যসম্ভার কিংবা সৃষ্টিকর্ম নয়, তার যাপিত জীবন, জীবনবোধ, নৈতিকতা ও আদর্শ সবটাই ছিল যেন অনন্য এক মহাকাব্য! আজ সেই সংগ্রামী লেখক সমরেশ বসুর জন্মদিন।

১৯২৪ সালের ১১ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিক্রমপুরে জন্মগ্রহণ করেন সমরেশ বসু। বাংলা সাহিত্য ও বাঙালি সাহিত্যিক হিসেবে ‘ব্যতিক্রমী’ শব্দটা তার ক্ষেত্রে কতখানি প্রযোজ্য এবং মানানসই, তা কেবল একজন মনযোগী পাঠকই বলতে পারবেন। সমরেস বসুর সময়টিকে বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগের সাথেও তুলনা করা যাতে পারে, কেননা একই সময়ে লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন তারাশঙ্কর, মানিক এবং খ্যাতির চূড়ায় থাকা বিভূতিভূষণের মতো জাদরেল লেখকেরা। কিন্তু সমরেশ বসু ছিলেন নিজস্ব পরিচয়েই অনন্য।

তাই ‘উত্তরসূরি’র কোন তকমা কোনভাবেই তিনি তার গায়ে লাগাতে দেননি! জীবন ও যাপনেও ব্যতিক্রমী এবং সংগ্রামী ছিলেন সমরেশ বসু। পিতা ভালোবেসে নাম রেখেছিলেন ‘সুরুথনাথ’ আমরা পরবর্তীতে যাকে পাই সমরেশ বসু হিসেবে। ছোটবেলা থেকেই সমরেশ ছিলেন উড়নচণ্ডী স্বভাবের। পড়াশোনায় আগ্রহ না থাকায় ঢাকার বিক্রমপুরের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছেন, প্রকৃতির মাঝে নিজেকে খুঁজে ফিরেছেন তিনি! এরই মাঝে মাত্র ১২ বছর বয়সে ৯ বছরের এক মেয়ের প্রেমে পড়ে যান। যার প্রভাবে পিতার আদেশে সমরেশের ঠাই হয় কলকাতার নৈহাটিতে। কিন্তু সেখানেও যথারীতি পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন।

ফলস্বরূপ স্বভাবতই পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে ফিরতে হয় আবারও নিজ বাড়িতেই। কিন্তু সেখানেও আর মন না টিকলে আবার নৈহাটিতেই ফিরেন উড়নচন্ডী সমরেশ এবং ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। কিন্তু দাদা ছিলেন তার চিকিৎসার ব্যাপারে উদাসীন। তাই এই সময়টিতে সমরেশের দেখাশোনার দায়িত্ব পড়ে দাদার বন্ধু দেবশঙ্করের স্বামী পরিত্যক্তা দিদি গৌরি এবং এরই সূত্র ধরে পরিণয়ে জড়িয়ে পড়েন সমরেশ-গৌরি। সমাজের সমস্ত বাঁধা উপেক্ষা করে বিয়েও করেন তারা, তবে সংসার শুরু হয় নানা অভাব অনটনে। পেটের ক্ষুধা নিবারণে কখনো মাথায় নিয়ে সবজি বিক্রি করেছেন, আবার কখনো বিভিন্ন কোয়ার্টারে মাথায় করে পৌছে দিয়েছেন ডিম।

১৯৪২ সালে সমরেশ জড়িয়ে পড়েন কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতিতে এবং ধীরে ধীরে কমিউনিস্ট ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হন। যোগ দেন শ্রমিক আন্দোলনে। পরবর্তীতে কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষিত হলে সংযুক্ততা থাকায় সমরেশ বসু কারাবন্দি হন। জেলে বসেই সমরেশ লিখে ফেলেন নিজের প্রথম উপন্যাস ‘উত্তরঙ্গ’।

এর আগে ‘নয়নপুরের মাটি’ নামক আরেকটি উপন্যাস লিখলেও তা প্রকাশ হয় ‘উত্তরঙ্গ’ এর পরে। জেল থেকে বের হয়ে তিনি লিখেছেন ‘গঙ্গা’, ‘প্রজাপতি’, ‘বিটি রোডের ধারে’ কিংবা কালকুট ছদ্মনামে ‘শাম্ব’ তার মতো বিখ্যাত সব উপন্যাস। তবে সমরেশের জীবন ও সাহিত্যের বিচারে এটুকু আবশ্যিকভাবে বলা যায়, কেবল আনন্দ দিতে কিংবা পাঠকের মনোরঞ্জন করতে কলম হাতে তুলে নেননি তিনি, বরং শিখিয়েছেন তার ভাবনায়, ভাষায় এবং অনুভবের গভীরতায়।

তবে এর জন্য বিতর্কিত ও সমালোচিতও হতে হয়েছে তাকে। স্রোতের বিপরীতে গিয়েই সমরেশ হয়েছেন তার সাহিত্য সৃষ্টির কারিগর। আর তার সকল সাহিত্যকর্মই তার যাপিত জীবনের অঙ্গ। লেখক হিসেবে সমরেশ বসু তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছেন কিনা সেক্ষেত্রে হয়ত আলোচনা থেকে যায়, কিন্তু তার গভীর ব্যক্তিত্ববোধ ও সংগ্রামী জীবন বর্তমান পাঠকদেরও ভাবনার জায়গাকে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে।

Publication Link: https://www.newsg24.com/feature-news/14104/?fbclid=IwAR3_ax7m3-NktL59EIWowVHjyn8cK-bkBaXHd7cyaJ49vMQD6juFDmTlHlI

No comments:

Pages